আমাদের শুকতারা
ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ।সদ্য কৈশোরে পদার্পণ করা দূরন্ত কিশোরদের বশে আনার জন্য শহরের মা-বাবাদের জন্য সর্বোত্তম একটি জায়গা।৩য় শ্রেণির ভর্তি পরীক্ষায় টিকেছে ব্যাস আর কোন কথা নেই।বছরের শুরুতে এক ছুটির দিনে ব্যাগ-ব্যাগেজসহ ছেলেকে তুলে দিয়ে আসতেন কুদরত-ই-খুদা হাউস কিংবা জয়নুল আবেদিন হাউসের কোন একটিতে।শেষ মুহূর্তে বিদায় নেয়ার সময়ে ৮ বছরের ছেলেটির চোখ যতই আবেগ মিশ্রিত জলে ছলছল করতো না কেন,অনেক অনুরোধ করেও এবং নিজে আর কোন দিন দুষ্টমি করবে না বলেও মা-বাবাকে সেদিন সে বুঝাতে পারত না।মা-বাবার বিদায়ের সেই মুহূর্তে ছেলেটির সেই চোখের জলের সাথে হাউসের বাগানের হলুদ ফুলগুলোর রঙ মিলে এক অসাধারণ দৃশ্যের অবতারণ করতো।
মা –বাবার চোখ দিয়েও সেদিন জল গড়িয়ে পড়তো।কিন্তু সেটা মেরুন রঙের ইট-য়ালা সেই হাউসগুলো থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর।কিন্তু তবু তাদের স্বপ্নগুলোর তুলনায় এই বিন্দুমাত্র চোখের জল অনেক বেশিই নগণ্য ছিলো।তাদের স্বপ্ন একটাই যে তাদের দুষ্ট ছেলেটি এই ৫০ একরের সবুজ ক্যাম্পাস থেকে প্রাণরস আহরণ করে মনের দিক থেকে একজন ভালো মানুষ এবং ভবিষ্যতে একজন স্বপ্নদ্রষ্টা টগবগে তরুণ হয়ে বের হয়ে আসবে।
মডেল কলেজ সম্পর্কে মা-বাবাদের মনে ভালো ধারণাটি কখনি আপনাআপনি জন্ম হয়নি।সন্তানদের নিয়ে তাদের স্বপ্ন দেখার মাত্রাটা আরো বেড়ে যেত মডেল কলেজের ঠিক পিতা-মাতার সমতুল্য শিক্ষক-শিক্ষিকাদের জন্য।যে মানুষগুলো সম্পূর্ণ পিতা-মাতার পরিপূরক এবং কোন কোন দিক থেকে তা থেকেও বেশি।সদ্য হাউসে তুলে দিয়ে আসা ৮ বছরের কিশোরটির কাছে হাউস মাস্টার কিংবা হাউস টিউটর স্যার ম্যাডামরাই তখন পিতা-মাতার সমতূল্য।
রাতের আকাশের শুকতারার মতন যে মানুষগুলো সেই অবুঝ বয়সটির ছোট্ট কিশোরটির মনে স্বপ্নসঞ্চার করতেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আমাদের সবার প্রিয় শ্রদ্ধেয় ফেরদৌস আরা বেগম ম্যাডাম।ম্যাডামকে সেই ক্লাশ থ্রিতে প্রথম দেখা থেকে শুরু করে ১০ বছর পর কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে বের হয়ে আসার আগ পর্যন্ত যতবারই দেখেছি এবং যতদিনই দেখেছি ততবারই ম্যাডামের মুখে হাসি দেখেছি।যে হাসিটি দেখলে যত খারাপই মনটা থাকুক না কেন,তা ভালো হয়ে যেত।যে অল্প কয়জন মানুষ থেকে জীবনটাকে নতুন করে চিনতে শিখেছি,তাঁদের মাঝে ম্যাডাম একজন।
তৃতীয় শ্রেণির বাচ্চাদের নাইট ক্লাসগুলো অন্য সবার থেকে কিছুটা বাতিক্রম ছিলো। কোন একজন পড়তে পড়তে বাসার কথা মনে করে কান্না করেছে তো খবর হয়েছে! তার দেখাদেখি কান্নাটা সংক্রমিত হয়ে ছড়িয়ে যেত ক্লাসের সবার মাঝে।তবে হ্যাঁ,এক্ষেত্রে যদি ফেরদৌস আরা ম্যাডাম গার্ড পড়তেন তাহলে কান্নাটা বেশি দূর পর্যন্ত গড়াতো না। ম্যাডাম নিজে ছেলেগুলোর কাছে যেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে গল্প করে অল্পতেই মন ভালো করে দিতেন।একটু আগে কান্না করা ছেলেটিও কিছুক্ষণ পর হাসতে শুরু করতো গল্প শুনতে শুনতে।নাইটক্লাস শেষ করে বাচ্চা ছেলেগুলো হাউসে ফিরে এসে দুধ- ব্রেড(ওরিয়েন্ট ব্রেড) টিফিন খেয়ে স্লিপিং ড্রেস গায়ে দিয়ে নিজেই নেভি-ব্লু মশারি টানিয়ে ১০ টার মাঝেই ঘুমের প্রস্তুতি নিত।কেননা লাইট ১০টার পর বন্ধ হয়ে যাবে।
তারা সবাই ঘুমিয়ে গেলে রাতের বেলা ১১.০০ টার দিকে রাউন্ডে আসতেন হাউস মাস্টার ফেরদৌস আরা ম্যাডাম।একাই রুমে রুমে যেয়ে টর্চ লাইট জ্বালিয়ে দেখতেন যে ছেলেগুলো ঠিকমতন শুয়েছে কিনা,মশারি গুজেছে কিনা।দেখা যেত অনেকেরই মশারি ঠিক নেই,ম্যাডাম নিজ হাতে ঠিক করে দিতেন।অনেকেরই গায়ে কাঁথা নেই,ম্যাডাম নিজ হাতে ছেলেটির গায়ে কাঁথা দিয়ে দিতেন।অনেক ছেলেই ভুলে স্লিপিং ড্রেসের শার্টটার বোতাম না লাগিয়েই ঘুমিয়ে পরেছে,ম্যাডাম নিজ হাতে বোতামগুলোকে লাগিয়ে দিতেন যাতে বুকে ঠাণ্ডা না লাগে।কোন কোন রুমে যেয়ে দেখতেন যে কোন ছেলে বাসার কথা মনে করে বালিশে মাথা গুজে কান্না করছে,ম্যাডাম নিজে তখন তার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে গল্প করতে করতে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে উঠতেন।কোন রুমে যেয়ে দেখতেন যে কেউ হয়তোবা ভুলে বিছানাই নষ্ট করে ভিজিয়ে শুয়ে আছে।এভাবে শুয়ে থাকলে ঠাণ্ডা লাগবে তাই ম্যাডাম নিজেই তখন বাচ্চা ছেলেটিকে ডেকে তুলে নিজ হাতেই কাপড় পাল্টে দিতেন।বাচ্চাটি ভয়ে ভয়ে বলত- “টিচার টিচার সত্যি আমি কিছু করিনি,এখানে ভুলে পানি পড়ে গিয়েছিল!” ম্যাডাম নিজে তখন বলতেন যে, “আমি জানিতো বাবা তুমি কিছু করনি,এখানে পানিই পড়েছে।কিন্তু এভাবে ঘুমিয়ে গেলে ঠাণ্ডা লেগে যাবে যে!” ম্যাডাম তখন ভিজা জায়গাটাতে শুকনো মোটা কাঁথা দিয়ে তার উপরে বাচ্চাটিকে শুইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে যেতেন।আর ম্যাডাম ওয়ার্ডবয়কে তখন বলে যেতেন ,সবাই ক্লাসে যাওয়ার পর তার তোষকটিকে রোদে শুকাতে দিতে এবং তার সাদা চাদরটিকে ধুয়ে দিয়ে শুকিয়ে আয়রন করে আবার আগের মতন বিছিয়ে দিতে এবং পুরো কাজটি সবাই দুপুর ১টা বাজার পর ক্লাস শেষে রুমে আসার আগেই করতে,যেন কেউ বিষয়টি না জানে।
দুপুরের ডাইনিং অনেকেই মাছের কাঁটা বাছতে জানত না।ম্যাডাম নিজ হাতে তখন ছেলেগুলোকে কাঁটা বেছে বেছে ভাত খাইয়ে দিতেন।প্যারেন্টস ডে হতো ২ মাস পর পর।কাজের জন্য অনেক ছেলেদেরই মা-বাবা আসতে পারতেন না।ছেলেটির যাতে মন খারাপ না হয় এজন্য ম্যাডাম নিজ হাতে রান্না করে ছেলেটিকে বাসায় ডেকে খাওয়াতেন।কলেজের কোন প্রতিযোগিতা শুরু হলে তো কথাই ছিল না।বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা,সংস্কৃতিক সপ্তাহ,আন্তঃ হাউস বাগান প্রতিযোগিতা,আন্তঃ হাউস বাংলা/ইংরেজি বানান প্রতিযোগিতা,আন্তঃ হাউস বিতর্ক প্রতিযোগিতা,আন্তঃ হাউস ফুটবল/ক্রিকেট/ভলিবল/বাস্কেটবল/ক্যারাম/টেবিল-টেনিস প্রতিযোগিতা,আন্তঃ হাউস আজান-কিরাত প্রতিযোগিতা,আন্তঃ হাউস দেয়াল পত্রিকা প্রতিযোগিতা,আন্তঃ হাউস দলীয় অভিনয় প্রতিযোগিতা,সাপ্তাহিক পরিষ্কার- পরিছন্নতা প্রতিযোগিতা – যেটাই থাকুক না কেন ম্যাডামকে আমরা সবগুলোতেই পেতাম আমাদের সাথের অনেক বেশি কাছের সঙ্গী হিসেবে।এতটা সজীব প্রাণশক্তি যে একজন মানুষের থাকতে পারে সেটা কখনই জানতাম না ফেরদৌস আরা বেগম ম্যাডামকে সামনাসামনি না দেখলে।
ক্লাস ফাইভে “ভাষা প্রতিযোগ” কিংবা ক্লাস এইট থেকে টেন পর্যন্ত “বিটিভির আন্তঃস্কুল বিতর্ক প্রতিযোগিতা” গুলোর সব গুলোতেই ম্যাডামকে আমরা অনেক কাছ থেকে পেয়েছিলাম।ম্যাডাম নিজ হাতে আমাদের প্র্যাকটিস করিয়েছিলেন সেসময়।কোন আবদার নিয়ে গেলে ম্যাডাম কোনোদিন আমাদেরকে ফিরিয়ে দেন নি।
নাইট ক্লাস চলাকালীন সময়ে ফেরদৌস আরা ম্যাডাম রাউন্ডে আসতেন।আর আমরা তখন ম্যাডামকে ধরে বসতাম আমাদের কবিতা পড়িয়ে শুনাতে।ম্যাডাম কোনোদিন আমাদেরকে না করেননি।ম্যাডাম তখনই আমাদের আবৃত্তি করে শুনাতেন কোন সুন্দর কবিতা।ইন্টার-ফার্স্ট ইয়ারে একসময় লিউকেমিয়া/ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়লো সবথেকে কাছের বন্ধুটির।আমার এখনো মনে পড়ে ম্যাডাম তখন নিজে পিজি হাসপাতালে এসে বন্ধুটিকে সাহস দিয়ে গিয়েছিলেন।কোন এক কারণে ম্যাডামের চোখেও সেদিন দেখেছিলাম আবেগ মিশ্রিত জল। তার কিছুদিন পর ম্যাডাম আমাকে খুব কাছে ডেকে বলেছিলেন, “প্রান্ত,আহনাফ এবার ইন্ডিয়া থেকে আসলে আমার বাসায় নিয়ে এসো,ওকে আমি নিজহাতে রান্না করে খাওয়াবো”।
একটা জিনিস কি,টিচার তো সবাই হতে পারেন কিন্তু ছাত্রদের মনটাকে জয় করতে পারেন কয়জন?ম্যাডাম আপনি এই দিকটা থেকে সম্পূর্ণ সফল।মডেল কলেজ থেকে আপনাকে কাছে পেয়ে পাশ করে বের হওয়া কেউই আপনাকে কখনই এ জীবনে ভুলবে না।
এইতো সেদিনই কলেজে গিয়ে ম্যাডামের সাথে দেখা।ম্যাডাম প্রথম দর্শনেই বললেন, “শাহরিয়ার প্রান্ত, এখন চুল যতই বড় করো না কেন আমরা কেউ তোমাকে কিছুই বলবো না!” তার পরেই একদম কাছে টেনে জিজ্ঞেস করলেন যে কেমন আছি।
আরেকদিন অন্য একটি কাজে ম্যাডামের বাসায় গিয়েছিলাম।সেদিন ম্যাডাম নিজ থেকে পাশে বসে অনেকক্ষণ গল্প করেছিলেন।একপর্যায়ে ম্যাডাম নিজ হাতে রান্না করা খাবার খাইয়েছিলেন এবং খাওয়ার সময় নিজ হাতে মরিচ বেছে সরিয়ে দিয়েছিলেন।এমনকি চলে যাবার সময় ম্যাডাম নিজ হাতে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে দিয়েছিলেন।
একটা জিনিস কি আমরা অনেক বেশিই ভাগ্যবান।কেননা এধরণের মানুষের সংস্পর্শে আর কয়জনই বা দশটি বছর থাকার সুযোগ পায়।অন্যদের তুলনায় এই দশবছরে যতটা না হারিয়েছি,তার তুলনায় পেয়েছি অনেক বেশি।এসব গল্পগুলো শুধুই আমাদের।আর কারো জায়গা নেই এখানে।আমাদের সবার গল্পগুলোই একই সুতোয় গাঁথা।
অনেক অনেক ধন্যবাদ শ্রদ্ধেয় ফেরদৌস আরা বেগম ম্যাডাম।আপনাকে না পেলে মডেল কলেজ জীবনটাতে অনেক বেশিই অপূর্ণতা রয়ে যেত।অনেক অনেক ধন্যবাদ মা।স্বপ্নজয়ের মুহূর্তগুলোতেও ঠিক আগের মতন আপনাকে আমরা পাশে পেতে চাই।স্রস্টা আপনাকে অনেক বেশি সুস্থ এবং ভালো রাখুক।
সহযোগিতায়ঃ
শাহরিয়ার প্রান্ত
কলেজ নং – ৯৯০২
ব্যাচ – ১৩
(২০০৫-২০১৫)